সারাদেশে ছেলে ধরা (কল্লাকাটা) গুজব ছড়িয়ে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে অনেককে হত্যা করা হয়েছে এবং অনেকের জীবনে গজব নেমে এসেছে। আমরা কোথায় আছি???! গুজব ছড়িয়ে মানুষ মারার নিষ্ঠুর প্রবণতা থামছে না। এ পর্যন্ত ১৭ জেলায় নিহত হয়েছে ৭ জন। আহত হয়েছে ৩৫ জন। বিভিন্ন থানায় জিডি হয়েছে ১৫টি, মামলা হয়েছে ৯টি, গ্রেপ্তার হয়েছে ৮১ জন। কিন্তু গুজব থামছে না। গুজবের শিকার যারা হয়েছেন তাদের মধ্যে হৃদয় বিদারক বাড্ডা থানার অধীন তছলিমা রেনু। নিকটস্থ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজ মেয়ের স্কুল ভর্তির বিষয়ে জানতে এসে গণপিটুনিতে নিহত হন রেনু। বেনু স্কুল গেইটে এলে কথাবার্তার এক পর্যায়ে দুই যুবক তাকে এসে এলোমেলোভাবে ছেলেধরা বিষয়ে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাস করে। সে স্কুলে কি জন্য এসেছে তা বলে, কিন্তু ওই যুবকরা তার কোন কথাই বিশ্বাস করেনি। এক পর্যায়ে তাকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের রুমে নেয়। এসময় বাইরে ছড়িয়ে পড়ে এক ছেলে ধরা মহিলাকে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়ে আটকিয়ে রাখা হয়েছে মর্মে এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে কয়েক’শ উঙ্খৃল মানুষ বিদ্যালয়ের গেইট ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে প্রধান শিক্ষকের রুম থেকে জোর জবরদস্তি করে রেনুকে টেনে হেঁচড়ে বাইরে এনে পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় মৃত্যুর পরও তার বুকের উপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করছে উঙ্খৃল লোকজন। এ নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের ভিডিও ফুটেজ গণমাধ্যমে ভাইরাল হলে সারাদেশে মানুষের মুখে একটিই কথা আমরা কোথায় আছি, কোন দেশে, কোন সমাজে বসবাস করছি ? যে সমাজে এ নিষ্ঠুরতা হয়। এ দায় কে নেবে এ প্রশ্ন এখন সবার কাছে ? রেনু দুই সন্তানের জননী। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরে। অনেক আগে স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তার বড় ছেলের বয়স ৮ বছর, ছোট মেয়ের বয়স ৪ বছর। ছোট মেয়ের স্কুলে ভর্তির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে রেনু এ নিষ্ঠুরতার শিকার হন। রেনুর বড় ভাই রিয়াজ মাহমুদ আমেরিকা প্রবাস থেকে বোনের এ নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি বক্তব্য পোষ্ট করেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, ছোট বেলা হতে কিছুটা নার্ভাস প্রকৃতির রেনু ছিল খুব মেধাবী। স্কুলে কখনও দ্বিতীয় হয়নি। সব সময় ফার্স্ট গার্ল থাকতো। বাবা রেনুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন সে ডাক্তার হবে নয়তো সরকারি বিসিএস কর্মকর্তা। কিন্তু সংসার জীবনটা রেনুর সুখের হয়নি। ছোট ছোট দুটি সন্তান নিয়ে সে একাই জীবন অতিবাহিত করছিল। সংসার ভেঙে গেছে বেশ আগেই। বাবা ও মা মারা গিয়েছেন। রেনু নিজের মতো করেই সন্তানদের ভাল স্টুডেন্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। ছোট বাচ্চাটার মাত্র চার বছর বয়স। ও সারা জীবন অভাগা ছিলেন। মেয়েকে নিয়ে প্রবাসে আসার কথা ছিল, তা আর হয়ে উঠেনি। সে কখনো গুছিয়ে কথা বলতে পারতো না, কোন বিষয়ে প্রতিবাদ করতো না, নিরবে সহ্য করে যেত। মৃত্যুর আগে আমার বোন তছলিমা রেনু সবাইকে তাকে পিটিয়ে হত্যার সময় বলেছিল “ভাইগো ও ভাই, আমি এখানে এসেছিলাম আমার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে..., আমি ছেলে ধরা না। আমার নাম তাসলিমা রেনু। দুটো বাচ্চা আছে আমার। আমি মরে গেলে ওদের কেউ থাকবে না। এখনো যদি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান আমি মরবো না। আমি সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে চাই। বাসায় বাচ্চাগুলো আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।” রেনুর এ আকুলতা নিষ্ঠুর হত্যাকারীদের হৃদয় গলেনি। শেষ পর্যন্ত তাকে পিটিয়েই মেরে ফেলা হলো।
গুজবের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সকল জেলা পুলিশ সুপারকে এ ছেলে ধরা (কল্লাকাটা) গুজবের বিরুদ্ধে কঠোর প্রদক্ষেপ নিতে বলেছেন এবং কতটি মামলা হয়েছে ও কতজন গ্রেফতার হয়েছে তা জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
এ গুজবে প্রাণ হারিয়েছে আরো বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে রয়েছে কিশোর, মানষিক প্রতিবন্ধি, শ্রমজীবী মানুষ ও অসহায় পিতা। এ নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায় ? এসব ঘটনায় গোটা জাতি স্তম্ভিত। সচেতন মহলের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে এগুলো কেন হচ্ছে ? কারা করছে ? কি কারণে করছে ? এর প্রতিকার কি? আর যারা নিহত হলেন তাদেরই বা কি অপরাধ ছিল?
(নুরুল করিম মজুমদার)
সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক হকার্স
সাবেক সভাপতি, ফেনী প্রেস ক্লাব