নুরুল করিম মজুমদার-
ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে নৃশংস খুন এবং বরগুনার শাহনেয়াজ রিফাত শরিফকে প্রকাশ্য দিবালোকে স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে হত্যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তড়িত গতিতে ভাইরাল হওয়ায় গোটা জাতিকে নাড়া দিয়েছে এবং এ দুই ঘটনায় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে।
গত ২৭ মার্চ ২০১৯ সোনাগাজী ইসলামী ফাজিল মাদ্রাসার আলীম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌল্লা কর্তৃক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এ ঘটনার পর রাফির মা, ভাই ও স্বজনরা এর প্রতিবাদ করতে গেলে অধ্যক্ষের অফিসে পুলিশ দিয়ে তাদেরকে অপদস্থ করে বের করে দেওয়া হয়। একই দিন রাফি সোনাগাজী থানায় এ ব্যাপারে জিডি করতে গেলে থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন কর্তৃক সেখানেও লাঞ্ছনার শিকার হয়। রাফির মা সোনাগাজী মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির নিকট অভিযোগ দিতে গেলে সেখানে তিনি হুমকি-ধমকির শিকার হন। ২৬ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত এ সময়ে রাফি এবং রাফির স্বজনরা বিচার চেয়ে সর্বত্র ধর্ণা দিয়েছেন। রাফি কোন জায়গা থেকে বিচারও পাননি এবং পুলিশের সহায়তাও পাননি। ফলে হত্যাকারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। ২৭ মার্চ থেকে অধ্যক্ষ পুলিশি হেফাজতে থাকার পরও অধ্যক্ষের নির্দেশে তার বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্ররা ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন সেন্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাত জাহান রাফির শরিরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। টানা ৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১০ এপ্রিল নুসরাত জাহান রাফি ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে মারা যায়। এ ঘটনায় ফেনী মডেল থানায় মামলা হয়।
অপরদিকে, নুসরাতের সাথে অসদাচরণ, যৌন হয়রানি মূলক আচরণ এবং তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল করায় সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)র মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ব্যারিস্ট্রার সাইদুল হক সুমন একটি রিট আবেদন করেন। রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নির্দেশ দেন। এ প্রেক্ষিতে পিবিআই ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে চার্জশিট দাখিল করেন। হাইকোর্ট তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন এবং ঢাকা থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। রাফি হত্যা মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজসহ ২১ জন পিবিআই গ্রেফতার করে। এরমধ্যে ১৬ জন আসামীর বিরুদ্ধে পিআইবি আদালতে চাজশিট দাখিল করেন পরে ৫ জনকে চার্জশিট থেকে অব্যহতি দেয়ায়। বর্তমানে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে বিচারাধীন আছে। বর্তমানে ৯ জন স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। তাই বিচারাধীন এ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়া সমোচিন মনে করি না।
রাফি হত্যার ঘটনার সাথে প্রিন্সিপাল ছাড়া বাকী সকল আসামিগণই মাদ্রাসা ছাত্র এবং ওই মাদ্রাসা প্রাক্তন ছাত্র। এ রকম একটি নিষ্ঠুর ঘটনা সহপাঠীদের দ্বারা সংগঠিত করার ঘটনায় গোটা জাতি স্তম্ভিত। শুধু তাই নয় এ ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সেখানে রাফিকে চরিত্রহীন আখ্যায়িত করা এবং সে নিজে আত্মহত্যা করেছে বলে অপপ্রচারও চালানো হয়েছে। অধ্যক্ষ সিরাজ মুক্তি আন্দোলন পরিষদ গঠন এবং এ পরিষদের ব্যানারে মানববন্ধন পালনের মত দৃষ্টতাও দেখানো হয়েছে।
অপরদিকে, গত ২৬ জুন বরগুনার শাহনেয়াজ রিফাত শরিফ নামে এক যুবকে বরগুনা সরকারি কলেজের গেইট থেকে ধরে নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নয়ন বন্ড নামে একটি গ্র“পের ২০ জন এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। এরমধ্যে নয়ন বন্ড ছাড়াও তার বন্ধু রিফাত ফরাজিসহ ১০/১২ জন রিফাতকে প্রথমে মারধর করে কলেজ গেইট থেকে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে একজন রিফাতকে ধরে রাখে, বাকি দুই জন হাত ধরে কুপিয়ে ৫ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডে এ নৃশংস ঘটনা সম্পন্ন করে। এ সময় তার ঘাড়ে এবং বুকে কুপিয়ে তাকে হত্যা করে। বাকীরা কোন রকম প্রতিবন্ধকতা যাতে সৃষ্টি না হয় তার জন্য পাহারায় ছিল। ইতোমধ্যে ৯ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এ ঘটনাটি সোস্যাল মিডিয়ায় ফুটেজ ভাইরাল হওয়ার পর প্রতিবাদের ঝড় উঠে। স্বাভাবিকভাবে গোটা জাতি স্তম্ভিত এবং এর প্রতিবাদে সারাদেশে মানববন্ধন, মিছিল ও সভা সমাবেশ করেন। সবচেয়ে দুঃখজন হলেও সত্য যে, শাহনেয়াজ রিফাত শরিফ ওই দিন তার কলেজ পড়–য়া স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নিকে বরগুনা সরকারি কলেজ থেকে আনতে গিয়ে এ ঘটনার শিকার হন। রিফাতের স্ত্রী আয়েশা আক্তার মিন্নি হামলাকারীদের প্রাণপণ বাধা দিয়েও স্বামীকে বাঁচাতে পারেননি। অবশ্যই এ ব্যাপারে কারো কারো ভিন্ন মত রয়েছে বলেও মিডিয়াতে খবর এসেছে। এ বিষয়টি আমাদের কাছে মুখ্য নয়।
জানা গেছে, নয়ন বন্ড এবং রিফাত ফরাজি ‘০০৭ বন্ডের’ সক্রিয় সদস্য। এরা দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ছত্রছায়া পেয়ে চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। তাদের এ অপকর্ম সম্পর্কে গোটা এলাকাবাসী দীর্ঘদিন থেকে দেখে আসছে কিন্তু কেউ মুখ খুলেনি। এ দুটি ঘটনায় গোটা জাতি স্তম্ভিত ও হতভম্ভ। মিডিয়াতে খবর আছে রিফাত ফরাজি বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ভায়রার পুত্র।
মিডিয়াতে খবর প্রকাশিত হয়েছে দেশে প্রতি ঘন্টায় ১২ জন খুন হচ্ছে। এর মধ্যে হত্যা, আত্মহত্যা, হামলা এবং সড়ক দুর্ঘটনায় এরা নিহত হয়। সমাজ কোথায় যাচ্ছে এ বিষয়ে এখন সমাজ সচেতন ব্যক্তিরা চিন্তিত। হাইকোর্টের বিচারপতি এএফএম নাজমুল হাসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ব্র্যঞ্চ বিষ্ময় প্রকাশ করে বলেছেন “সমাজ কোথায় যাচ্ছে”? এ প্রশ্ন শুধু হাইকোর্ট ব্র্যঞ্চের নয়, গোটা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের। বাংলাদেশে এমন নৃশংস ঘটনা এ প্রথম নয়। প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যার অনেক দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। পুলিশের অপরাধ সংক্রান্ত ফাইলে এবং পুরোনো সংবাদপত্র স্ক্যান করলে অনেক ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে। ঘটনাগুলো ঘটার পরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত এবং সামাজিকভাবে প্রতিবাদ হলেও এ নৃশংস ঘটনাগুলোর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। রাফি এবং রিফাত হত্যাকান্ড সামাজিক অবক্ষয়ের এক দগদগে ক্ষত চিহ্ন। দেশে এমন হত্যাকান্ড কেন ঘটছে, কেউ হত্যাকান্ডে বাধা দিচ্ছে না, হত্যাকারীরা কেন এমন বেপরোয়া হয়ে উঠছে তা সকলের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। কেউ মনে করেন বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফলে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে, আবার কেউ কেউ মনে করেন সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে এ ধরণের অপরাধ বাড়ছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন গণতন্ত্রহীণ সমাজ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে প্রতিবাদ করতে সাহস পায়না। ফলে ভয়ের আবহ পুরো সমাজকে ঘ্রাস করে ফেলেছে। গোটা জাতিকে, সমাজ সচেতন ব্যক্তিদের, রাজনৈতিক নেতাদের এর প্রতিকার খুঁজতেই হবে। অন্যথায় জাতিকে এক অন্ধকারের জায়গা নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, সাপ্তাহিক হকার্স
সাবেক সভাপতি, ফেনী প্রেস ক্লাব।