
মোতাহের হোসেন ইমরান : উত্তর চরসাহাভিকারী গ্রামের বলরাম বাড়ির যজ্ঞেশ্বর মজুমদার পেশায় পান চাষী। ২ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে তার সংসার। জন্মলগ্ন থেকে এ পেশার সাথে জড়িত। পরিবার থেকেই এ পেশায় আসা। তার বাপ-দাদারাও এ পেশায় জড়িত ছিলেন। দিনের অধিকাংশ সময় কাটে পানের বরজে সময় দিয়ে। পানের বরজ তার সংসারের আয়ের উৎস্য। তিনি জানান, ‘৬০ শতক জমিতে পান চাষ করে বছরে প্রায় ৬-৭ লক্ষ টাকার পান বিক্রী করে। তার মধ্যে ৩/৪ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। আগে পান চাষ করে জমি কিনছি, এখন খরচ বেশি লাভ কম’। যজ্ঞেশ্বর মজুমদারের মত সোনাগাজী উপজেলায় ৮০-৯০ জন কৃষক পান চাষের সাথে জড়িত। পান চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন এখানকার চাষিরা। এই এলাকার সফল পান চাষীদের মধ্যে রয়েছেন শেখ আহাম্মদ, অনাথ বন্ধু মজুমদার, আলী আহাম্মদ, মজল হক, আব্দুস সাত্তার, মো: হানিফ, সামছুল হক, ফজলুল হক, সেকান্তর মিয়া, পরেশ মজুমদার। উপজেলার চরদরবেশ ও চরমজলিশপুর ইউনিয়নে প্রায় ১৭ হেক্টর জমিতে পান চাষের আবাদ। এ এলাকার মাটি পান চাষে উপযোগী হওয়ায় চরদরবেশ ইউনিয়নের চরসাহাভিকারী গ্রামে দিন দিন পান বরজের সংখ্যা বাড়ছে। এখানকার উৎপাদিত পান ফেনী জেলার চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ হচ্ছে নোয়াখালী-কুমিল্লা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এসে স্থানীয় সোনাগাজী, কাজিরহাট, দাসের হাট, কেরামতিয়া বাজার থেকে সপ্তাহে দুই দিন পান সংগ্রহ করে সড়ক ও নদী পথে নিয়ে যান। এলাকায় ৮০-৯০ জন পান চাষি তাদের শ্রম কাজে লাগিয়ে পান চাষ করে বদলে দিচ্ছে তাদের পরিবারের ভাগ্য। আদিকাল থেকে মানুষ খাবারের অন্যান্য আনুষাঙ্গিকতার পাশাপাশি পান খেয়ে আসছে। বর্তমানে বাজারে বহু ধরনের পান পাওয়া যায়। পানের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে এক খিলি পান এখন ৫ টাকা থেকে শুরু করে ১০ টাকা পর্যন্ত গড়িয়েছে। সুস্বাদু মিষ্টি পান যে কারো খাবারে রুচি জোগায়। শ্রাবণ মাস থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত পানের ডগা (কাটিং) করে রোপন করা হয়। কয়েকজন পান চাষী জানান, বর্ষা মৌসুমে পানের উৎপাদন একটু বেশি হয়। শীত মৌসুমে পানের উৎপাদন কমে যায়। পানে নানা রকম ভেষজ গুণ রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তিতে পান চাষে অনেক কিছু ব্যবহার করা হলেও জৈব সার ও গোবর খৈল বেশী পরিমাণে দেওয়া হয়। চাষাবাদের এক-দেড় মাস না যেতেই বরজে বিক্রির মত পান ফুটে উঠে। পান চাষের জন্য দরকার উঁচু, বন্যামুক্ত, বেলে, দোআঁশ বা এটেল দোআঁশযুক্ত জমি। ছায়াযুক্ত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া পান চাষের জন্য ভাল। বাংলা, মিঠা, সাচি, কর্প‚রী, গ্যাচ, নাতিয়াবাসুত, উজানী, মাঘি, দেশী, বরিশাল ও ঝালি প্রভৃতি জাতের পান বরজে চাষ করা হয়। পান গাছকে ছায়া দেয়া ও প্রবল বাতাসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উন্নতমানের বরোজ তৈরি করতে হয়। বরোজ তৈরিতে পাকা বাঁশ/খুঁটি, বাঁশের চটা, ছন বা কাশ জাতীয় ঘাস, খড় এসবের দরকার হয়। খুঁটি চারিদিকে পোঁতার পর তাতে বাঁশের চটা, ছন/খড় দিয়ে ছাউনি ও শুকনা কলাপাতা, খেজুর পাতা, সুপাড়ি পাতা এসব দিয়ে বেষ্টনী বা বেড়া দেয়া হয়। ভেতরে চারা রোপনের পর প্রয়োজনমত কাঠি দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। উত্তর চরসাহাভিকারীর গ্রামের পান চাষী সুভাষ মজুমদার জানান, পান লাভজনক ফসল। চাষের জন্য কোন কাজের লোক রাখতে হয় না। অবসর সময়ে ব্যয় করেন পান বরজের পিছনে। উৎপাদন খরচের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ লাভ হওয়ায় বরজ পাল্টে দিয়েছে তার অভাবের সংসারের চিরচেনা স্মৃতি। পানের এই আয় থেকেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি স্বাবলম্বী হচ্ছেন তারা। কিনেছেন ফসলি জমিও। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ইস্কান্দার হানিফ বলেন, পান চাষ বর্তমান সময়ে একটি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। চাষীরা যথাযথভাবে এই চাষ করলে অবশ্যই সফলতা আসবে। বর্ষা মৌসুমে পানের উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাজারে দাম কম থাকে। আর শীতে ফলন কম হওয়ায় দাম চড়া থাকে। মাঠে পানের উৎপাদন বাড়ানো, রোগ-ব্যাধি নির্ম‚ল, সার ও কীটনাশকের সঠিক ব্যবহারে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। চরদরবেশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ভুট্টু বলেন, আমাদের এলাকার উৎপাদিত পান সুস্বাদু হওয়ায় তা সরবরাহ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। পান চাষকে ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যাচ্ছে। পান চাষ করে বদলে দিয়েছে গোটা ইউনিয়নের পরিবেশ। পান চাষীরা অনেক সময় অর্থনৈতিক দৈন্যতায় থাকে। তাদের জন্য যথাযথভাবে সরকারি সাহায্য সহযোগিতা করা যায় তাহলে পানচাষীরা তাদের ভাগ্য বদল করতে পারবে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো: শরিফুল ইসলাম জানান, সোনাগাজীতে প্রায় ১৫-১৭ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়। পান চাষের সঠিক প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেলে এ এলাকায় কৃষক পরিবারগুলোর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। সে সঙ্গে মজবুত হবে অর্থনৈতিক মেরুদন্ড। অনেক চাষীই এরই মধ্যে চাষ ব্যবস্থা পাল্টিয়ে পান চাষে আর্থিক সাফল্য অর্জন করেছেন। পান চাষে লাভ বেশি হওয়ায় দিন দিন চাষীর সংখ্যা বাড়ছে।