
লোকমান বিএসসিঃ ভালো নেই পালপাড়ার কুমোরেরা। ৩০ বছর আগেও নোয়াপুর পালপাড়ায় ৪০টি কুমোর পরিবার ছিল। মৃৎশিল্পের কদর কমায় বর্তমানে এই সংখ্যা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে ৫/৬ এ। কৃষ্ণ কুমার পাল, মরণ চন্দ্র পাল, শ্যামল চন্দ্র পাল, অনীল চন্দ্র পাল ও সুনীল চন্দ্র পালরা এখনো এই পেশায় টিকে থাকার চেষ্টা করলেও বাকীরা পাড়ী জমিয়েছে ভিন্ন পেশায়। মরন চন্দ্র পালের ছেলে প্রকাশ চন্দ্র পালের (২৯) বাপের পেশায় আগ্রহ নেই। তিনি পাশ্ববর্তী গ্রাম বদরপুরে সেলুন দিয়েছেন। রমজানের পড়ন্ত বিকেলে ফেনী- পরশুরাম আঞ্চলিক মহা সড়কের নতুন বাজারের মাঝামাঝি পশ্চিমের রাস্তা ধরে এগুতে থাকলাম।সাথে সহকর্মী সংবাদকর্মী শাখাওয়াত হোসেন শাখা। ভাঙ্গাচোরা রাস্তার সবখানে এক শ্রেনীর মুনাফা লোভীদের নির্মমতার চাপ। ইটের সুরকি খুইয়ে খুইয়ে পড়ছে। সামান্য দুর গেলেই কাঁচা রাস্তা। রাস্তায় অসংখ্যক খানা-খন্দক। উপজেলার প্রায় সবগুলো রাস্তা কম বেশী পাকাকরণ করা হলেও এই রাস্তাটি যুগের পর যুগ এভাবেই রয়ে গেছে। দেড় থেকে দুই কিলোমিটার পথ পশ্চিমে এগুলেই নোয়াপুর পালপাড়া। এটি ফুলগাজী উপজেলার ২ নং মুন্সীরহাট ইউপি একটি গ্রাম। গ্রামের উত্তর পূর্বাংশে প্রায় দু'শ বছর পুরোনো পালপাড়া। একটা সময় এ অঞ্চলের কুমোরদের মাটির তৈরী হাড়ি- পাতিল, বাসন-কোসন, কলস, বদনার ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। সময়ের আবর্তনে এখন তা পুরিয়ে গেছে অনেকটাই। এ কারনে কুমোর বাড়ীর সেই চাকা এখন আর তেমন ঘোরে না। তবে মাটির তৈরী কিছু জিনিষের কদর এখনও আছে। পালপাড়ায় ঢুকে প্রকাশ চন্দ্র পাল নামে একজন তরুনের সাথে কথা হয়। সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে একজন বয়ষ্ক কুমোরের সাথে কথা বলার ইচ্ছা জানানো হয় তাকে। তিনি তাঁর নিজের বাড়ীতেই নিয়ে গেলেন আমাদের।বাড়ীতে ঢুকতেই চোখে পড়ল কুমোর বাড়ীর ঐতিহ্য এবং সেই সাথে দারিদ্র্যের চাপ। পাশাপাশি তিনটি ছোট বড় মাটির ঘর। ঘরের আঙ্গীনায় অল্প কিছু মাটির তৈরী জিনিষ পত্র। তিনি শতবর্ষের কাছাকাছি একজন ভদ্র মহিলাকে ডাকলেন। সম্পর্কে ইনি তাঁর পিসি( ফুফু) হন। নাম ননীবালা পাল। প্রায় ৬০/৭০ ধরে এই পেশায় আছেন তিনি। কেমন আছেন জানতে চাইলেই একরাশ অভাব অভিযোগের কথা শুনালেন। প্রথমে তিনি আমাদের কোনো সরকারি সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানেরর লোক ভেবেছিলেন। পরক্ষনে সংবাদকর্মী জানতে পেরে খানিকটা হতাশ হলেন বৈকি। ননী বালা পালের বিয়ে হয়েছিল আনন্দপুরের ধোপাইচড়ি গ্রামে। ছেলে চিত্তরঞ্জনের জন্মের পরপরই স্বামী শ্রীমন্ত পাল মারা যান। এরপর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ী নোয়াপুরে উঠেন। বাবা অচিরাম পাল দুই শতক ভূমিতে মাটির ঘর তৈরী করে দেন। তারপর বংশানুক্রমে তিনি ৬০/৭০ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত। বাপ-দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন এখনো। মাটির হাড়ি- পাতিল, ঢাকনা, কলস, পিঠা তৈরীর খোলা ইত্যাদি তৈরী করেন তিনি।ছেলে চিত্তরঞ্জন সেগুলো পুরাতন মুন্সীরহাট বাজারে বিক্রি করে কোনো রকম সংসার চালায়। ছেলে চিত্তরঞ্জনেরর চার মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। সেজন্যে বেশ আফসোস এই শতবর্ষির। ৩০ বছর আগেও এই পালপাড়ায় ৪০টি কুমোর পরিবার ছিল। কিন্তু মাটির জিনিষের কদর নেই আগের মতো। ঘরে ঘরে প্লাষ্টিক, পলিপ্রপিলিনের তৈরী পাত্রের কদর। আর দার দাপটে বাজারে মাটির কুঁজো কলসি, জালার চাহিদা কমে গেছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আগের মতো বিক্রি নেই মাটির জিনিষ পত্রের। তাইতো কুমোর পাড়ার বেশীর ভাগ লোকই বেচে নিয়েছে ভিন্ন পেশা। কৃষ্ণ চন্দ্র পাল, মরন চন্দ্র পাল, শ্যামল চন্দ্র পাল, অনিল চন্দ্র পাল, সুনিল চন্দ্র পাল সহ মাত্র ৫/৬ পরিবার এখনো বাপ-দাদার এই পেশায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।